বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫, ৫ ভাদ্র ১৪৩২
ইমাম আবু হানিফা (রহ.)
স্মরণীয় মুসলিম মনীষী

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইসলামী ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং ইসলামী ফিকাহ বা শরিয়াহর একজন মহান ইমাম। তার পূর্ণ নাম ছিল নুমান ইবনে সাবিত ইবনে জুয়াইন। তিনি হিজরি ৮০ সনে (৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে) ইরাকের কুফা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সাবিত (রহ.) ছিলেন একজন সৎ, ধার্মিক ব্যবসায়ী এবং তার পূর্বপুরুষ পারস্যের অধিবাসী ছিলেন বলে জানা যায়।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এমন এক যুগে জন্মগ্রহণ করেন যখন সাহাবায়ে কেরামদের অনেকেই তখনো জীবিত ছিলেন এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও অনুশাসন সরাসরি তাদের মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছিল। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন, যিনি কুফা শহরে ইসলামী জ্ঞানের বিস্তার করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও ধর্মপ্রাণ। প্রথমদিকে তিনি তার পিতার মতো ব্যবসায়ে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আলেমদের সংস্পর্শে এসে তিনি জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ইলমে দ্বীন অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি বিশেষত হাদিস, তাফসির ও ফিকাহ শাস্ত্রে গভীর গবেষণা করেন। তার প্রধান ও প্রভাবশালী উস্তাদের নাম হলো ইমাম হাম্মাদ ইবনে আবি সুলায়মান। প্রায় ১৮ বছর তিনি তার সান্নিধ্যে থেকে ইলম অর্জন করেন এবং পরবর্তীকালে তার স্থলাভিষিক্ত হন।

ইমাম আবু হানিফার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তার তর্কসংগত যুক্তিবোধ ও গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা। তিনি ফিকাহশাস্ত্রে কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি কোরআন-হাদিসের নির্যাস মথিত নিজস্ব ‘রায়’ ও ‘কিয়াস’ (যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ)-এর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি ফিকাহকে একটি যৌক্তিক, শৃঙ্খলিত ও সহজবোধ্য কাঠামোতে পরিণত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত মতবাদ, যা হানাফি মাজহাব নামে পরিচিত, পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্বে অন্যতম প্রধান চারটি মাজহাবের একটি হিসেবে গৃহীত হয়। হানাফি মাজহাব বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তুরস্ক, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চলে বহুল প্রচলিত।

ইমাম আবু হানিফা শুধু একজন বড় মুফতি ও ইমামই ছিলেন না, বরং একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার, সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ। তিনি রাজদরবারের প্রভাব থেকে দূরে থাকতেন এবং খলিফাদের পক্ষ থেকে বিচারপতির পদ প্রস্তাব পেলেও তা গ্রহণ করেননি। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর তাকে যখন কাজির (বিচারপতি) পদে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি তা অস্বীকার করেন এবং এর ফলে তাকে কারাবন্দি করা হয়। কারাগারেই তিনি শেষ জীবন অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই ১৫০ হিজরিতে (৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে) তার ইন্তেকাল হয়।

মৃত্যুর পর কুফা শহরে লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করে, যা ছিল তৎকালীন ইতিহাসে এক বিরল দৃশ্য। তার ছাত্রদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.), ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ও জুফার ইবনে আবি ইউনুস ছিলেন উল্লেখযোগ্য, যারা হানাফি মাজহাবকে সুসংগঠিত ও সমৃদ্ধ করেন।

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর রেখে যাওয়া জ্ঞানের ভান্ডার শুধু তৎকালীন সমাজে নয়, বরং আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং মুসলিম উম্মাহর ফিকাহ ও ধর্মীয় অনুশাসনের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তার অবদান চিরকাল মুসলিম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

মন্তব্য করুন