প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর (এমই) বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের সরবরাহ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ক্রমবিকাশমান বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান পর্যায় এবং ক্ষুদ্র উদ্যোগের গুরুত্ব বিবেচনা করে সমন্বিত সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এ তহবিল ঘাটতি কমানোর এখনই উপযুক্ত সময়।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি শীর্ষ পর্যায়ের উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) তিন দশকের বেশি সময় ধরে নিজ কর্মসংস্থান এবং মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে বিভিন্ন আর্থিক এবং অ-আর্থিক পরিষেবার সমন্বয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোগ উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে আসছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ সত্ত্বেও ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর গড় তহবিল ঘাটতি প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ‘ক্রেডিট এনহ্যান্সমেন্ট স্কিম (সিইএস)’ নামে পিকেএসএফ একটি নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য, ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি করা।
ক্ষুদ্র উদ্যোগের গুরুত্ব ও সম্ভাবনা: বাংলাদেশে মোট ৭.৮ মিলিয়ন উদ্যোগের মধ্যে ৮৯ শতাংশই ক্ষুদ্র উদ্যোগ, যারা মোট কৃষিবহির্ভূত কর্মসংস্থানের প্রায় ৫৬ শতাংশ সৃষ্টি করে। সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো স্থানীয় কাঁচামালের মূল্য সংযোজন করে এবং দক্ষ ও অদক্ষ উভয় ধরনের জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। একটি টেকসই জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য স্থানীয় অর্থনীতিতে এসব উদ্যোগের অবদান অপরিহার্য। ক্ষুদ্র উদ্যোগে নিযুক্তদের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। এসব জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বৈষম্য হ্রাস এবং বহুমাত্রিক দারিদ্র্য দূরীকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে এই ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো।
প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষুদ্র উদ্যোগ গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে এই উদ্যোগগুলো গ্রামীণ-শহর অভিবাসন হ্রাস করতে এবং গ্রামীণ-শহর অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নারী মালিকানাধীন বা তাদের দ্বারা পরিচালিত, যা জেন্ডার সমতা বৃদ্ধি করে এবং সম্পদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর্থিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি করে।
বাংলাদেশে যুব বেকারত্বের হার প্রায় ১৫.৭৪ শতাংশ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ফল হিসেবে প্রতি বছর ২০ লাখের বেশি তরুণ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। তাদের জন্য যথাযথ কর্মসংস্থানের বিষয়টি দেশের আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে স্টার্টআপ, ইনকিউবেশন সার্ভিসের মতো নতুন নতুন কর্মসূচিসহ ক্ষুদ্র উদ্যোগ উন্নয়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ এ কর্মসংস্থানের চাহিদা মেটাতে এক কার্যকর মাধ্যম হতে পারে।
তহবিল ঘাটতি: অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান সত্ত্বেও অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোগ এখনো প্রয়োজনীয় আর্থিক ও অ-আর্থিক পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। যারা সেবা পাচ্ছে, তাদের জন্যও তা পর্যাপ্ত নয়। আইএনএম, বিশ্বব্যাংক, আইএফসি এবং এসক্যাপের মতো প্রতিষ্ঠানের গবেষণা অনুযায়ী, মূলত মূলধনের অভাবই ক্ষুদ্র উদ্যোগ খাতের প্রবৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা। যদিও প্রতি বছর এ খাতে ঋণ বিতরণ বাড়ছে। তবুও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল। এসক্যাপের ২০২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর গড় অর্থায়ন ঘাটতি প্রায় ৮৬ শতাংশ, যা নতুন ও উদ্ভাবনী অর্থায়ন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি স্পষ্ট করে।
বিদ্যমান আর্থিক অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা: বাংলাদেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান অবকাঠামো দেশব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোর আর্থিক চাহিদা পূরণে পুরোপুরি উপযোগী নয়। বিদ্যমান কাঠামোতে বিপুলসংখ্যক ছোট ছোট ঋণ বিতরণ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক নয়। এখন পর্যন্ত এমএফআইগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোগ খাতে সবচেয়ে বড় অর্থায়নকারী। তাদের নিজস্ব উৎস হতে অর্থায়নের সক্ষমতা সীমিত, যা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। পিকেএসএফ তিন দশক ধরে সহযোগী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে দেশব্যাপী ক্ষুদ্র উদ্যোগ উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। পিকেএসএফ একটি কার্যকর মূল্যায়ন ও তদারকি পদ্ধতি এবং শক্তিশালী এমএফআই রেটিং ব্যবস্থা ব্যবহার করে, যার মাধ্যমে ঝুঁকি নিরূপণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দক্ষতার সঙ্গে এমএফআইগুলোকে অর্থায়ন করতে পারে। তবে তহবিলের যে বড় ঘাটতি রয়েছে, তা পিকেএসএফের পক্ষে একা দূর করা সম্ভব নয়।
ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পিকেএসএফের অনেক সহযোগী সংস্থাকে ঋণ দিয়ে থাকে। কিন্তু ব্যাংকগুলো পিকেএসএফের মতো এমএফআই অর্থায়নে বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান নয়। আর্থিক প্রতিবেদন ও মাধ্যমিক তথ্য-উপাত্তের ওপর নির্ভর করার কারণে তারা অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পরিমাণে অর্থায়ন করতে সক্ষম হয় না। পিকেএসএফ ও ব্যাংকের মধ্যে একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব এ ঘাটতি পূরণ করতে পারে, ব্যাংকের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে এবং সব অংশীজন বিশেষ করে মাইক্রোএন্টারপ্রাইজগুলোর তহবিল স্বল্পতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করতে পারে।
পিকেএসএফের নতুন উদ্যোগ: এই প্রেক্ষাপটে পিকেএসএফ পরীক্ষামূলকভাবে একটি ‘ক্রেডিট এনহ্যান্সমেন্ট স্কিম (সিইএস)’ চালু করেছে, যা মূলত একটি ঝুঁকি ভাগাভাগির পদ্ধতি এবং প্রচলিত ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের চেয়ে ভিন্ন। ব্যাংক কর্তৃক সহযোগী সংস্থাগুলোকে অর্থায়নের ক্ষেত্রে সিইএস বিভিন্ন স্তরে ব্যাংকের ঝুঁকি হ্রাস করবে—
এক. ক্রেডিট গ্যারান্টি: ব্যাংক কর্তৃক সহযোগী সংস্থাগুলোকে তাদের ক্ষুদ্র উদ্যোগ অর্থায়ন কার্যক্রমে প্রদানকৃত ঋণ বকেয়া পড়ার যে ঝুঁকি, তার একটি অংশ পিকেএসএফ বহন করবে।
দুই. ঋণ মূল্যায়ন ও সার্টিফিকেশন: পিকেএসএফ তার মানসম্পন্ন রেটিং ব্যবস্থার মাধ্যমে সহযোগী সংস্থাগুলোর সার্বিক পাফরম্যান্স ও ঋণ প্রাপ্যতা মূল্যায়ন এবং ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য তাদের সার্টিফাই করবে।
তিন. মাঠপর্যায়ে তদারকি: সিইএসের আওতায় ব্যাংকের অর্থায়নকৃত ঋণের ব্যবহার পিকেএসএফ মাঠপর্যায়ে নিবিড়ভাবে তদারকি করবে। পিকেএসএফের অনেক সহযোগী সংস্থা ব্যাংকের জামানতের শর্ত (যেমন—স্থায়ী আমানতের ওপর লিয়েন বা স্থাবর সম্পত্তির জামানত) পূরণে অক্ষম। ফলে তারা ক্ষুদ্র উদ্যোগ অর্থায়ন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে পারে না। সিইএস এ ধরনের সীমাবদ্ধতা দূর করে ব্যাংক অর্থায়নে তাদের প্রবেশাধিকারের সুযোগ বৃদ্ধি করবে। বিশেষ করে ছোট এবং দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার সংস্থাগুলোর জন্য এটি বিশেষভাবে সহায়ক হবে।
সাধারণত ব্যাংকগুলো বড় সংস্থাকে ঋণ দিতে পছন্দ করে। কারণ, এতে ঝুঁকি কম বলে বিবেচিত হয়। সিইএস ব্যাংক ঋণের সুবিধা আকার ও ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে সব সংস্থার মধ্যে ন্যায্য বণ্টনে সহায়তা করবে।
প্রত্যাশিত ফলাফল ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: সিইএস এমন একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম হবে, যেখানে ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো ঋণের প্রবাহ বাড়াতে পিকেএসএফ, ব্যাংক ও এমএফআই একসঙ্গে কাজ করবে। প্রতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা ও আর্থিক ঝুঁকি কমিয়ে সিইএস ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষুদ্র উদ্যোগ খাতে বড় পরিসরে অর্থায়নের সুযোগ দেবে।
এই স্কিমটি প্রত্যাশিতভাবে:
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি করবে; প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকে সহায়তা করবে; আয় বৈষম্য হ্রাস করবে; অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করবে ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো বিকাশের মাধ্যমে সিইএস উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে, কর্মসংস্থান তৈরি করে এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রেক্ষাপট পাল্টে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: সমন্বয়কারী, এমএফসিই প্রকল্প, পিকেএসএফ
মন্তব্য করুন