বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫, ৬ ভাদ্র ১৪৩২
রাজশাহী ব্যুরো
গবেষণা, র‍্যাংকিং, উচ্চশিক্ষায় অগ্রযাত্রার সারথী

পদ্মাতীরের এক কুঠিবাড়ি থেকে দেশের শীর্ষ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পার করেছে গৌরবের ৭২ বছর। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতিতে রেখেছে অবিস্মরণীয় অবদান। প্রতিষ্ঠা পেয়েছে উত্তরাঞ্চলের উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে। তবে সাত দশক পেরিয়ে গৌরবের নানা অর্জনের পাশাপাশি কিছু সংকট এখনো রয়ে গেছে। যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষক সংকট, শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট, রয়েছে সেশনজটও।

মাত্র ১৬১ জন নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের অধিক। সঙ্গে যুক্ত আছেন ১,০১২ জন শিক্ষক ও বিপুলসংখ্যক গবেষক। ৭৫৩ একরের ক্যাম্পাসজুড়ে মোট ১২টি অনুষদ, ৫৯টি বিভাগ ও ৬টি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ আধুনিক অবকাঠামো রয়েছে। রয়েছে ১৪টি একাডেমিক ভবন, ১৭টি আবাসিক হল, আন্তর্জাতিক ডরমিটরি, গ্রন্থাগার, আইসিটি সেন্টার, জাদুঘর, স্টেডিয়াম, সুইমিং পুলসহ নানা সুবিধা।

শিক্ষা ও গবেষণায় নানামুখী সফলতা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গৌরবজনক অবস্থান গড়ে তুলেছে। উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিন পুনরুদ্ধারে সাফল্য ও পানিকে আর্সেনিক দূষণমুক্ত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন, ‘গ্রিন চিলি পাউডার’ ও সজনে পাতার গুঁড়া তৈরি। ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. এএইচএম খুরশীদ আলমের চার সবজি থেকে ক্যান্সার প্রতিরোধী গুণ ও তুঁত গবেষণায় ক্যান্সার ও হৃদরোগ প্রতিরোধী আবিষ্কার। একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলামের পাটের বিকল্প আঁশ উদ্ভাবন, ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসেনের উন্নত প্রজাতির মাছ গবেষণা এবং বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছের ৮ প্রজাতির হাওরে ফিরিয়ে আনার অবদান।

এ ছাড়া বিরল অর্কিড কাঞ্চন, ফুলের জীবন্ত চিত্রকর্ম, মাটি ছাড়া ঘাস ও আনারস চাষে টিস্যু কালচার প্রযুক্তি উৎপাদনে সফলতা পেয়েছেন এগ্রোনমি বিভাগের অধ্যাপক ড. গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু রেজার দেশের প্রথম সাপের বিষের ডাটাবেজ তৈরি, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার শোভনের গেছো শামুকের ক্যাপটিভ প্রজননে সাফল্য এবং একই বিভাগের অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেনের হাত ধরে আর্সেনিক দূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে গবেষণা।

এদিকে লবণ ছাড়া চামড়া সংরক্ষণের টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনে দেশের প্রথম সফল গবেষণা করেছেন ফলিত রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম। প্লাজমা টেকনোলজি ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছেন ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ তালুকদার এবং পদার্থবিদ্যায় রাবির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার বসাকের সফলতা। এসব গবেষণা দেশের বাস্তব ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে।

বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির হার কয়েক বছর ধরে ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি শিক্ষার্থীসহ ভর্তি হয়েছেন ১৮ জন বিদেশি শিক্ষার্থী। বর্তমানে ৯টি দেশের ৩৩ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন পর্যায়ে অধ্যয়ন করছেন।

গবেষণায় জাতীয় শীর্ষ ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা: সবশেষ যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল নেচার ইনডেক্স র‍্যাংকিং মার্চ ২০২৫ অনুযায়ী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের মধ্যে গবেষণায় শীর্ষস্থান দখল করেছে। এর আগে স্কোপাসের জরিপে দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গবেষণায় সবার শীর্ষে অবস্থান করেছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। ইউএস গ্লোবাল নিউজ র‍্যাংকিং ২০২৫ অনুযায়ী বিশ্বের গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় এর অবস্থান ৬৩৮তম।

বিজেএস ছাড়িয়ে বিসিএসেও রাবির বাজিমাত: এ বছর ৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৬২ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এর মধ্যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে চতুর্থ ও প্রশাসনে পঞ্চমসহ ১৭ জন, তা ছাড়া শিক্ষা ক্যাডারে প্রথম, দ্বিতীয়সহ পুলিশে দশম, লাইভস্টকে তৃতীয়, আনসারে ষষ্ঠ, খাদ্য ও আনসারসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন রাবির মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সের এক বিভাগ থেকেই ১৫ জন শিক্ষার্থী সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

অন্যদিকে, গত চার বছর টানা প্রথম স্থান অর্জনসহ বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষাতেও বরাবরের মতো সফল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। সবশেষ ১৭তম বিজেএসে রাবির আইন অনুষদ থেকে মোট ২৮ জন শিক্ষার্থী সহকারী জজ হিসেবে মনোনীত হয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক মো. আখতার হোসেন মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাডেমিকভাবে সন্তোষজনক অবস্থানে রয়েছে এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায়ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান তৈরি করেছে।

তবে আমাদের দায়িত্ব হলো বাজার চাহিদাভিত্তিক গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা। এ জন্য কারিকুলাম আধুনিকায়নের চেষ্টা চলছে।’

নানা সফলতার পাশাপাশি বিদ্যমান সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয়কে এক অনন্য মাত্রায় নেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ড. মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আবাসিক সংকট কাটিয়ে উঠতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এরই মধ্যে নতুন পাঁচটি হল নির্মাণের প্রস্তাব সরকারে পাঠিয়েছে। এর পাশাপাশি ছেলেদের একটি নতুন হলের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ, ডিসেম্বরের মধ্যে সেখানে ১১ শতাধিক শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাবেন। মেয়েদের একটি হলের কাজও শেষের দিকে, আগামী বছরেই উদ্বোধন করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সেশনজট নিরসনে প্রতিটি বিভাগের সেমিস্টার ও পরীক্ষাগুলো যেন নির্ধারিত সময়েই শেষ হয় সে বিষয়েও নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুতই এ সংকট কেটে যাবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ্ হাসান নকীব কালবেলাকে বলেন, ‘দেশের দ্বিতীয় প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের সঙ্গে ৭২ বছরে পদার্পণ করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব স্টেকহোল্ডারকে শুভেচ্ছা জানাই।’

গবেষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাবি বর্তমানে গবেষণা, র‍্যাংকিং ও উচ্চশিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো করছে। আমরা শিক্ষক-গবেষকদের পাশাপাশি ছাত্র-গবেষকদেরও উৎসাহ দিতে বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছি। পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে নাম-রোলবিহীন কোডিং-ডিকোডিং ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে।’

প্রতি বছরের মতো প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এ দিনটিকে উদযাপন করবেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ শুভানুধ্যায়ীরা।

মন্তব্য করুন