চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাগবিতণ্ডার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দেখা যায়, উপাচার্যের কক্ষে তার আসন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ সময় একজন বলে ওঠেন, ‘আপনি নিজ যোগ্যতায় বসেননি, আপনাকে আমরা বসিয়েছি। আপনি আমাদের কথা শুনতে বাধ্য।’
শুক্রবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তীর পদোন্নতি বোর্ড বসানোর আগে এ ঘটনা ঘটে। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পরে পদোন্নতি বোর্ড প্রত্যাহার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, কার্যালয়ে উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কথোপকথনের শুরুতে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আপনাকে এখানে বসিয়েছি, অবশ্যই যাতে আপনি আমাদের সঙ্গে কাজ করেন।’ জবাবে উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহহিয়া আখতার বলেন, ‘না।’ (তিনি মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাতে থাকেন)। এরপর উপাচার্যের সামনে ও পাশে বসা কয়েকজন একযোগে কথা বলতে থাকেন। এ সময় উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের কার্যক্রম দেখ আগে।’ উত্তরে উপাচার্যের পাশে বসা এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আপনি বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করবেন, ছাত্রদের জন্য কাজ করবেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করবেন। একটা কথা রেখেছেন? একটা কথা রাখেননি স্যার।’
এ পর্যায়ে সামনে দাঁড়ানো এক শিক্ষার্থী আবার বলেন, ‘আপনাকে আমরা বসাইছি, আপনি নিজের যোগ্যতায় আসেননি স্যার।’ উপাচার্য তখন পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘কী করেছি আমি?’ তখন
সামনে দাঁড়ানো ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আপনারা কেন কুশল বরণকে প্রমোশন দিচ্ছেন আমাদের রক্তের সঙ্গে এবং আমাদের বিপ্লবের সঙ্গে বেইমানি করে।’ এরপর একাধিক শিক্ষার্থী হট্টগোল করতে থাকেন। পরে উপাচার্যের সামনে বসা এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেন, ‘যারা আহত করেছে আমাদের তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?’ এ সময় উপাচার্য বলেন, ‘শোন আগে। মাঝখানে কথা বল কেন। আচ্ছা তুমি বল, তুমি বল।’ অন্য এক শিক্ষার্থী এ সময় বলেন, ‘আমরা প্রতিদান চাচ্ছি না। কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? জুলাই-পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের নিয়ে কাজ করবেন…।’ জবাবে উপাচার্য বলেন, ‘ইউনিভার্সিটি হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট না। আমরা জেল-জরিমানা দিতে পারি না। শাস্তি দিতে পারি।’ এরপর শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন আবার একযোগে কথা বলতে শুরু করেন। এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই প্রশাসন একজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়নি।’ তখন উপাচার্য রাগতস্বরে বলেন, ‘বলতে থাকো।’ এই পর্যায়ে এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এই প্রশাসন দেশে সবচেয়ে বড় সুশীল প্রশাসন।’ অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘জুলাইয়ের পরে একজনের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়নি। আমাদের ভাইদের যারা হত্যা করছে তাদের কতজনকে আপনি শাস্তি দিছেন বলেন।’ উত্তরে উপাচার্য বলেন, ‘শাস্তি আমি একা পকেট থেকে বের করে দিতে পারি না।’ তখন একাধিক শিক্ষার্থী একযোগে বলতে থাকেন, ‘স্যার, একাডেমিক শাস্তি কয়জনের হয়েছে? প্রায় এক বছর হয়েছে। ডিমোশন না হয়ে আরো প্রমোশন হচ্ছে। আপনারা তাদের প্রমোশন দিচ্ছেন।’ তখন উপাচার্য ছাত্রদের উদ্দেশে বলেন, ‘হ্যাঁ, বলতে থাকো, বলতে থাকো।’
তারপর এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আজকে যে বোর্ড বসবে, সেই বোর্ড বসবে কি না এবং প্রমোশন দেবে কি না আমরা এটা জানতে চাচ্ছি।’ অন্য একজন বলেন, ‘স্যার জুলাইয়ে যারা সহযোগী হামলাকারী, তাদের আপনারা কীভাবে প্রমোশন দিচ্ছেন?’ এরপর আবারও কয়েকজন শিক্ষার্থী একযোগে কথা বলতে শুরু করেন। তারপর উপাচার্য কয়েকজনের মোবাইল সচল দেখে তাদের মোবাইল বন্ধ করতে বলেন। তখন তারা জানান, তারা সংবাদকর্মী। উপাচার্য তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোমরা পরে এসে আমার ইন্টারভিউ নিও।’
পরে শিক্ষার্থীদের পক্ষে একজন বলেন, ‘আজকে যার জন্য প্রমোশন বোর্ড বসছে, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। সে একজন হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি। তার নাম ২০ নম্বরে চার্জশিটভুক্ত। তার ব্যাপারে ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটিতে অভিযোগ গেছে। ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি যতদিন না সুপারিশ করছে, অন্তত ততদিন তো তার প্রমোশন আটকে রাখা দরকার।’
সেদিন উপাচার্যের কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ানো শিক্ষার্থীদের একজন ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী তাহসান হাবীব বলেন, ‘আমার কথায় এটি বুঝাইনি যে, উপাচার্যের একাডেমিক বা প্রশাসনিক কোনো যোগ্যতা নেই। আমি বোঝাতে চেয়েছি, উপাচার্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইউজিসি থেকে নিয়োগ পেয়ে আসেননি। শহীদদের রক্ত আর দিনের পর দিন বৃষ্টি, রোদে ভিজে আন্দোলনের পরে এই প্রশাসন এসেছে। এখন আমাদের শহীদদের রক্তের যে দাবি এবং জুলাইয়ের যে চেতনা এর বিপরীত কাজ যদি প্রশাসন করে, তখন সেটা তো আমরা মেনে নেব না।’
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাড়া মেলেনি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৬ নভেম্বর হেফাজতে ইসলামের কর্মী এনামুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হন। এ সময় তিনি কিরিচের কোপে মাথায় গুরুতর জখম হন এবং তার ডান হাত ভেঙে যায়। এ ঘটনায় বাদী হয়ে তিনি গত ৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণকে প্রধান আসামি করে ১৬৪ জনের নামে মামলার আবেদন করেন। এ মামলার ২০তম আসামি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তী।
মন্তব্য করুন