বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। এটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ও পোকামাকড় থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে। বর্তমানে চলছে বর্ষা মৌসুম। এ সময় মশার উপদ্রব বাড়ে, যা থেকে মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের পাশাপাশি অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে ডেঙ্গু।
বাড়ির আশপাশে বা যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন। ঘরবাড়ির আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয় পাত্রগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিন। বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় এবং আঙিনা পরিষ্কার রাখুন।
ব্যবহারযোগ্য পাত্রগুলো যেমন—বালতি, ড্রাম, ফুলের ও গাছের টব, ফ্রিজ এবং এয়ার কন্ডিশনারের নিচে পানিভর্তি পাত্রে কোনোভাবেই যেন একনাগাড়ে পাঁচ দিনের বেশি পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখুন এবং প্রয়োজনে অপসারণ করুন। এ ছাড়া অব্যবহৃত গাড়ির টায়ার, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত চৌবাচ্চা, পরিত্যক্ত টিনের কৌটা, প্লাস্টিকের বোতল/ক্যান, গাছের কোটর, পরিত্যক্ত হাঁড়ি, ডাবের খোসায় যেন পানি জমে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
শরীরের উন্মুক্ত স্থানে মশা ও অন্যান্য পোকামাকড় প্রতিরোধক ক্রিম বা স্প্রে ব্যবহার করুন। তবে এগুলো ব্যবহারের সময় শিশুর বয়স ও শিশুর ত্বকের জন্য ক্ষতিকর কি না, সে বিষয়ে লক্ষ রাখুন। প্রতিরোধক কেনার সময় প্যাকেটের গায়ে থাকা নির্দেশনা ভালোভাবে পড়ুন। শিশু ঘরের বাইরে যাওয়ার সময় তাদের যথাসম্ভব গা-ঢাকা পোশাক পরান। এ ক্ষেত্রে ফুলহাতা শার্ট ও টি-শার্ট, ফুল প্যান্ট, লম্বা ঝুলের ফ্রক, মোজা ও জুতা পরান।
ঘুমের আগে আলসেমি লাগলেও মশারি টানিয়ে নিন। শিশু ও বৃদ্ধদের বিছানায় মশারি টানাতে ভুলবেন না। কিছু সুগন্ধ মশার একেবারেই অপছন্দ। বাজারে নানারকম সুগন্ধি তেল পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে ল্যাভেন্ডার, ইউক্যালিপটাস, লেমনগ্রাস ও পিপারমিন্টের গন্ধ মশা সহ্য করতে পারে না। ঘরে এসব সুগন্ধ ব্যবহার করলে মশা দূরে থাকবে। এ ক্ষেত্রে নিমের তেল বেশ কার্যকর।
মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে ঘুমানোর সময় ঘরের জানালা একেবারে বন্ধ করলে ঘরে বাতাস চলাচল ব্যাহত হয়। তাই সমাধান হিসেবে জানালায় লাগানোর জন্য নানা মাপের মশার জাল কিনে নেওয়া যেতে পারে।
মশা আমাদের ঘামের গন্ধ অনুসরণ করে কামড় বসায়। তাই রাতে ঘুমানোর আগে গোসল করে নিলে ঘামের গন্ধ দূর হয় এবং মশার কামড় খাওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। এ ছাড়া বিছানার চাদর, বালিশ ইত্যাদিও গন্ধমুক্ত রাখতে হবে।
ভেষজ কিছু গাছ আছে, যেগুলো ঘরে টবের মধ্যে সাজিয়ে রাখলে মশার আনাগোনা কমে। যেমন রোজমেরি, পুদিনা, ভুঁইতুলসী, ক্যাটনিপ, রসুনগাছ ইত্যাদি।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
ডেঙ্গুর প্রধান লক্ষণ—জ্বর। ৯৯ থেকে ১০৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠতে পারে। জ্বর টানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও আসতে পারে। এর সঙ্গে শরীরে ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা এবং চামড়ায় লালচে
দাগ বা ফুসকুড়ি দেখা যায়।
যা করবেন না
ডেঙ্গু জ্বরের ক্ষেত্রে প্লাটিলেট এখন আর মূল বিষয় নয়। প্লাটিলেট হিসাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
প্লাটিলেট কাউন্ট ১০ হাজারের নিচে নামলে বা শরীরের কোনো জায়গা থেকে রক্তপাত হলে প্রয়োজন বোধে প্লাটিলেট বা ফ্রেশ রক্ত দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই কম দেখা যায়।
অনেকে বলেন, পেঁপে পাতার জুস ইত্যাদি খেলে প্লাটিলেট বাড়ে। আসলে এসবের কোনো ভূমিকা নেই। জ্বর কমে যাওয়ার পর সংকটকাল পেরিয়ে গেলে আপনা থেকেই প্লাটিলেট বাড়তে শুরু করে।
জ্বরের শেষের দিকে রক্তচাপ কমে যেতে পারে অথবা মাড়ি, নাক, মলদ্বার দিয়ে রক্তপাত হতে পারে। এরকম হলে প্রয়োজনে শিরাপথে স্যালাইন দেওয়া লাগতে পারে। এসব ক্ষেত্রে তাই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
কখন যাবেন হাসপাতালে
ডেঙ্গু হলে কী ধরনের চিকিৎসা নেবেন, বাসায় না হাসপাতালে থাকবেন—নির্ভর করে এর ধরন বা ক্যাটাগরির ওপর। ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ধরন বা ক্যাটাগরি আছে—‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’। প্রথম ক্যাটাগরির রোগীরা স্বাভাবিক থাকে। তাদের শুধু জ্বর থাকে। অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগী ‘এ’ ক্যাটাগরির। তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়াই যথেষ্ট।
‘বি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগতে পারে। কিছু লক্ষণ, যেমন পেটে ব্যথা, বমি, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, অন্তঃসত্ত্বা, জন্মগত সমস্যা, কিডনি বা লিভারের সমস্যা থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াই ভালো।
‘সি’ ক্যাটাগরির ডেঙ্গু জ্বরে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে।
বাড়িতে কী করবেন
পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
প্রচুর তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। ডাবের পানি, লেবুর শরবত, ফলের জুস এবং খাবার স্যালাইন পান করুন একটু পরপর।
ডেঙ্গু জ্বর হলে প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে। স্বাভাবিক ওজনের একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতিদিন সর্বোচ্চ আটটি প্যারাসিটামল খেতে পারবে। কিন্তু কোনো ব্যক্তির যদি লিভার, হার্ট ও কিডনিসংক্রান্ত জটিলতা থাকে, তাহলে প্যারাসিটামল সেবনের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে গায়ে ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন, ক্লোফেনাক, আইবুপ্রোফেনজাতীয় ওষুধ খাওয়া যাবে না। ডেঙ্গুর সময় এ জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রক্তক্ষরণ হতে পারে।
মন্তব্য করুন