বিশ শতকের পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক পর্যন্ত গোটা বিশ্ব এক অবিরত প্রাণক্ষয়ের সাক্ষি হয়েছিল। একের পর এক অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছে ভিয়েতনাম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতার ক্ষত আজও অনেকে বহন করে বেড়াচ্ছেন। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র পরাজিত হলেও ভয়াবহ এক গণহত্যা চালায়।
১৯৪৬-৫৪ পর্যন্ত ভিয়েতনামিরা প্রথম ইন্দোচীন যুদ্ধে লড়াই করে ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। এ যুদ্ধ শেষে ভিয়েতনামকে সাময়িকভাবে উত্তর ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে ভাগ করা হয়। সাম্যবাদীরা পায় উত্তর ভিয়েতনামের নিয়ন্ত্রণ আর দক্ষিণ ভিয়েতনামে সাম্যবাদবিরোধী শাসন শুরু করে। তবে উত্তর ভিয়েতনামের সাম্যবাদীরা একটি একত্রিত সাম্যবাদী ভিয়েতনাম গঠন করতে চাচ্ছিল। ১৯৫৯-৭৫ পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংঘটিত একটি দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সংঘাত এ ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এটি দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত। যুদ্ধের একপক্ষে ছিল উত্তর ভিয়েতনামি জনগণ ও ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট এবং অন্যপক্ষে ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামি সেনাবাহিনী ও মার্কিন সেনাবাহিনী।
এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকরা কিছুটা উদ্বেগে ভুগতে শুরু করেন। তাদের মনে হয়েছিল, সমগ্র ভিয়েতনাম সাম্যবাদী শাসনের অধীনে এলে ‘ডমিনো তত্ত্ব’ অনুযায়ী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তা ছড়িয়ে পড়বে। এ উদ্বেগ থেকেই ভিয়েতনাম বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে। তারা দক্ষিণ ভিয়েতনামে সাম্যবাদবিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। কিন্তু এ সরকারের নিপীড়নমূলক আচরণের প্রতিবাদে দক্ষিণ ভিয়েতনামে আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৬০ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করা হয়।
১৯৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ ভিয়েতনামি সরকারের পতন রোধকল্পে সেখানে সৈন্য পাঠায়; কিন্তু এর ফলে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, তাতে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হতে পারেনি। এ যুদ্ধে প্রায় ৩২ লাখ ভিয়েতনামের নাগরিক মারা যান। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৫৮ হাজার সেনা নিহত হন। যুদ্ধ বন্ধে প্যারিসে শান্তিচুক্তির লক্ষ্যে ১৯৬৯-৭৩ সালের মধ্যে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে বেশ কিছু বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভিয়েতনামের পক্ষ থেকে জুয়ান থুই, লি ডাক থো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০ থেকে শান্তি চুক্তির ব্যাপারে গোপনে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের ২৩ জানুয়ারি প্যারিসে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে ৮০ দিনের মধ্যে মার্কিন যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেওয়া, যুদ্ধবিরতি,দক্ষিণ ভিয়েতনামে সাধারণ নির্বাচন, দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন সহায়তা অব্যাহত রাখা এবং উত্তর ভিয়েতনামের সেনাদের দক্ষিণ ভিয়েতনামে অবস্থান অন্তর্ভুক্ত ছিল। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও সময়ের প্রয়োজনে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকে। কিছু অঞ্চলে তখনো যুদ্ধ চলছিল। ২৯ মার্চের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার করে। উত্তর ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ হতে থাকে। উভয়পক্ষই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে। মে ও জুন, ১৯৭৩ সালে কিসিঞ্জার এবং থো শান্তি চুক্তির উত্তরণে প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। ১৩ জুন, ১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং উত্তর ভিয়েতনাম যৌথভাবে প্যারিস চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বাক্ষর করে। ১৯৭৫ সালে সাম্যবাদী শাসনের অধীনে দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হয়। ১৯৭৬ সালে এটি সরকারিভাবে ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নাম ধারণ করে।
মন্তব্য করুন