বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫, ৫ ভাদ্র ১৪৩২
যুদ্ধবিরতি কি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ
চার রাত দুই দেশের মধ্যে দোষ চাপানোর খেলা চলল। দুই দেশের বড় শহরের আকাশ দিয়ে পাল্টাপাল্টি উড়ে গেল ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন। মনে হচ্ছিল পারমাণবিক অস্ত্রধর প্রতিবেশী দুই দেশ বোধহয় সর্বাত্মক যুদ্ধে মেনেই গেল! এরপর হঠাৎ করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা—এটা ছিল ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক যুদ্ধের চিত্র। একই দৃশ্য দেখা গেছে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে। ১২ দিনের যুদ্ধের পর সেখানে ঘোষিত হয়েছে যুদ্ধবিরতি। আসলে যুদ্ধবিরতি কী, এটি কেন জরুরি? এটি কি প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ থামায় নাকি মহাঝড়ের পূর্বলক্ষণ? ভারত-পাকিস্তান, ইরান-ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম, আজারবাইজান-আর্মেনিয়া, ইথিওপিয়া-টাইগ্রে, মিয়ানমার-এনইউজিসহ বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে ঘোষিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির ১৩ জুন ইরানের পারমাণবিক ও সারমিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইসরায়েল। প্রথমে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় তেহরান। আকস্মিক ধাক্কা সামলে জবাব দেয় তারা। পাল্টাপাল্টি হামলা-পাল্টা হামলার মধ্যে ২২ জুন ইরানের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ২৩ জুন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বন্ধে সম্মত বলে ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২৪ জুন থেকে এটি কার্যকর হয়েছে। সে সময় ইরান জানায়, ইসরায়েল যদি তাদের আক্রমণ বন্ধ করে দেয়, তবে তারা গোলাবর্ষণ বন্ধ করতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ইসরায়েল বলে, ইরানে তাদের লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। একই রকম পরিস্থিতি দেখা গিয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের সংঘাতের মধ্যে। ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন। এ ঘটনার জন্য পাকিস্তান সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠীকে দায়ী করে ৭ মে সে দেশে হামলা চালায় ভারত। পাল্টা আঘাত করে ইসলামাবাদও। চার দিনের যুদ্ধ শেষে ১০ মে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। উভয় ক্ষেত্রে পরস্পরকে হুমকি ও সতর্কবার্তা দিয়ে চলছে। ভারত ও পাকিস্তান অস্ত্র মজুত-উন্নয়নেও জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। ইরান ও ইসরায়েলও একই পথে হেঁটেছে। ভারত ও পাকিস্তান এবং ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে। এতে যুদ্ধবিরতি আদৌ টেকসই হবে কি না, তা নিয়ে এরই মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখন যদি যুদ্ধবিরতি বহাল থাকে, তাহলে আশা করা হচ্ছে যে, এটি একটি স্থায়ী শান্তিতে রূপ লাভ করবে। কিন্তু এর জন্য প্রচুর দক্ষ কূটনীতির প্রয়োজন হবে। যুদ্ধবিরতি বলতে কী বোঝায় জাতিসংঘের মতে, ‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দটির কোনো একক, সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। যদিও শব্দটি সামরিক আদেশ ‘Cease fire—যুদ্ধবিরতি’ শব্দটির থেকে এসেছে, যা ‘Open fire—গুলি করো’ আদেশের বিপরীত। এর মানে হলো যুদ্ধরত দুই পক্ষ তাদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে যেসব শর্তসাপেক্ষে যুদ্ধ বন্ধ করতে সম্মত হয়, সেটিই যুদ্ধবিরতি। একে ‘শান্তি চুক্তি’ এবং ‘অস্ত্রসংবরণ’ বলা যেতে পারে। জাতিসংঘ বলেছে, ‘যুদ্ধবিরতি’ এবং ‘সংঘর্ষ বন্ধ করা’র মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। জাতিসংঘের মতে, ‘সংঘর্ষ বন্ধ করা’ সাধারণত যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য একটি অনানুষ্ঠানিক চুক্তি। সাধারণত ‘যুদ্ধবিরতি’ অনেকটা আনুষ্ঠানিক হয় এবং এতে কিছু শর্ত থাকে, যেগুলোর আওতায় দুই পক্ষ চুক্তিবদ্ধ হয় এবং কেউ চুক্তি ভঙ্গ করলে ফের যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঝুঁকি থাকে। চুক্তির উল্লেখযোগ্য দিক—যুদ্ধবিরতির উদ্দেশ্য, কখন থেকে এটি কার্যকর হবে, এর পরের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, এটি কোন ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে, চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলো কোন কোন সামরিক কার্যকলাপ চালাতে পারবে, আর কোনটি পারবে না এবং যুদ্ধবিরতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে, তাও স্পষ্ট উল্লেখ থাকে। যুদ্ধবিরতি কি স্থায়ী না কি কেবল অস্থায়ী জাতিসংঘ বলছে, এটি উভয়ই হতে পারে। কখনো কখনো, যুদ্ধে লিপ্ত দুটি বিরোধী পক্ষ একটি অস্থায়ী বা প্রাথমিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এটি সহিংসতা কমাতে বা মানবিক সংকট কমানোর লক্ষ্যেও হতে পারে। যখন ইসরায়েল এবং হামাস-নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ২০২৩ সালের ২৪ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়, তখন হামাস প্রায় ২৪০ জন বন্দির বিনিময়ে ১০৫ জন জিম্মিকে মুক্তি দেয়। একটি প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি অনেক সময় এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারে, যাতে তা শান্তি আলোচনায় সহায়তা করে এবং একটি স্থায়ী বা একটি নির্দিষ্ট যুদ্ধবিরতির পথ তৈরি করতে সাহায্য করে। যেমন, ২০২১ সালের জুনের শেষের দিকে ইথিওপিয়ার সরকার টাইগ্রেতে মানবিক সহায়তা বিতরণের অনুমতি দেওয়ার জন্য একটি অনির্দিষ্টকালের জন্য মানবিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। এই যুদ্ধবিরতির মূল উদ্দেশ্য ছিল টাইগ্রে অঞ্চলে মানবিক সংকট মোকাবিলা করা এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংঘাতের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করা। তবে, অনেক সময় প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি ভেস্তে গেলে যুদ্ধ তীব্র আকারও ধারণ করতে পারে। যেমন নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে বহুবার যুদ্ধ ও যুদ্ধবিরতি হয়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া সংঘর্ষ চলে ছয় সপ্তাহ ধরে। রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে এটির সমাপ্তি হয়। কিন্তু ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফের সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্লেষকদের মতে, কিছু ক্ষেত্রে, যুদ্ধরত পক্ষের একজন বা উভয় পক্ষই যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে সময় ক্ষেপণের জন্য প্রাথমিক যুদ্ধবিরতিকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তবে দুটি বিবদমান পক্ষের মধ্যে সফল শান্তি আলোচনার পরই সাধারণত একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি স্থাপন করার সুযোগ হয়। এতে সাধারণত যুদ্ধরত বাহিনীগুলোকে নিরস্ত্রীকরণ, তাদের সামরিক সক্ষমতা কমানো বা কোনো বাহিনীকে পুরোপুরি বিলুপ্ত ও নিরস্ত্র করার মতো প্রক্রিয়া জড়িত থাকে। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে বহু বছর ধরে এসব প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। সীমিত যুদ্ধবিরতি মানে কী ইসরায়েল এবং হামাস ২০২৩ সালের নভেম্বরে তাদের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিকে ‘মানবিক বিরতি’ বলে অভিহিত করেছিল। মানবিক বিরতি কখনো কখনো যুদ্ধের সহিংসতা কমাতে বা মানবিক সংকট কমানোর জন্য করা হয়। ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সুনামির আঘাত হানার পর, ইন্দোনেশিয়ার সরকার এবং ‘ফ্রি আচেহ মুভমেন্ট’ উভয়ই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। যাতে তারা যে এলাকায় লড়াই করছে, সেখানে জরুরি সাহায্য পৌঁছে দেওয়া যায়। অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট এলাকায় যুদ্ধ বন্ধ করার জন্যও চুক্তি হতে পারে যাকে ভৌগোলিক যুদ্ধবিরতি বলা হয়। যেমন রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেনের মারিউপোল বন্দরে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ স্থানীয় জনগণকে রক্ষা করার জন্য লোহিত সাগরে ‘হোদেইদা’ বন্দরের আশপাশে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ইয়েমেন সরকার এবং হুতিদের মধ্যে একটি চুক্তি করে। গত মার্চে মিয়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দেশটির জান্তা সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়।
ভারত-পাকিস্তানের সংঘাতের ভবিষ্যৎ
আবার কি আক্রান্ত হতে পারে ইরান
আজারবাইজান আর্মেনিয়া যুদ্ধবিরতি
একক যুদ্ধবিরতি ইথিওপিয়ার
মুক্তির লড়াইয়ের আরেক নাম ভিয়েতনাম