সম্প্রতি সফিউদ্দিন শিল্পালয়ে আয়োজিত হয়ে গেল শিল্পী ঋতুরূপার তালুকদারের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ‘শক্তির রূপরেখা’। লড়াই, শক্তি ও মুক্তির পথে ধীরপায়ে হেঁটে যাওয়ার মতো এক বিশাল আঙিনা তৈরি করেছেন শিল্পী ঋতুরূপা তালুকদার তার প্রদর্শনীর ঘরটিকে। গ্যালারির দেয়ালে দেয়ালে শক্তির দেবী কালীর বিচিত্র রূপ আর ভঙ্গিমা। কখনো অসহায় মায়ের মতো দেবীর মুখে মেঘের ছায়া পড়ে, আবার সে ছায়াই অস্ত্রের ঝঙ্কারে বর্ষিত হয় অসুরের গায়ে। কখনো স্বৈরশাসকের মুণ্ডু হাতে প্রতিবাদী সৌরঝড় আছড়ে পরে প্রাচীন মহাকাশে। এই লড়াইয়ের অস্ত্রই আবার রূপান্তরিত হয় পাখিতে, মুক্তির ডানা মেলে শান্ত শিশুর মতো খুঁজে বেড়ায় আশ্রয়। শক্তিকে রূপরেখায় প্রকাশ করতে গিয়ে ঋতুরূপা দেবী কালীকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার প্রতিটি আঁচড়ে, এচিংয়ের প্লেটে। আঁচড় কেটে যাওয়া এচিংয়ের প্লেটখানিও অস্ত্রের রূপে প্রদর্শনীতে সরাসরি উপস্থিত হয়েছিল। অসহায়ত্বের বিপরীতে দেবী কালীর মতো শক্তির আবির্ভাব হোক প্রতিটি মায়ের মনে, শিল্পী তাই আশা করেন। ঋতুরূপার নিজের পারিবারিক আধ্যাত্মিকতার চর্চার পথ রূপান্তরিত হয় শিল্পের দ্বারে। কালীর উগ্র কিন্তু করুণাময়ী রূপ এখানে ছায়ার মতো নরম মিশ্র অনুভূতি তৈরি করে শিল্পীর চিত্রপটে। সেইসঙ্গে দর্শকেরও মনের উর্বর মাটিতে মুক্তির বীজ পুঁতে দেয়। ধীরে ধীরে মনে গেঁথে যায় তীব্র গতিতে হেঁটে চলা দেবী কালীর মৃত্যুঞ্জয়ী পায়ের ছাপ। চারুকলায় মাস্টার্সের শিক্ষাজীবনে নিজের একাগ্রচিত্র সাধনার মধ্য দিয়ে ঋতুরূপা তালুকদার এচিং মাধ্যমে অনেকগুলো কাজ করেছিলেন, সেখানেই শুরু হয়েছিল দেবী কালী চরিত্রের আবির্ভাব। ছবিগুলোতে নেই খুব বেশি রঙের উপস্থিতি। শুধু কালো আর লাল রং—যেন আমাদের টেনে নিয়ে যায় পুরাণের আদিম গন্ধমাখা সময়ে। শিল্পী যেন এ সময়ের ডালে প্রাচীন আর অর্বাচীনের মিশেলে ফুটিয়েছেন নতুন ফুল। এ সমাজে নারীদের মানসিক চাপ, অবহেলা, অসহায়ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মা কালীকে দাঁড় করালেন বিরোধী অসীম শক্তির বেদিতে। নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠটিকে রূপ দিয়ে আঁকলেন খড়গ, চাপাতি। আবার সেই খড়গই মুক্তির জয়গান গেয়ে কখনো মাছ বা পাখিতে রূপান্তরিত হলো। এখানে দেবী কালী আসলে একজন মৃত্যু ও সময়ের দেবী, আবার একজন করুণাময়ী মা। তিনি বিপ্লবী সত্তা হিসেবেও পরিচিত। তবে প্রদর্শনীতে এর বাইরেও শিল্পীর ভিন্ন ধারার কিছু কাজও স্থান পেয়েছিল।
উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগে বার্ষিক প্রদর্শনীতে সফিউদ্দীন ‘গ্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড’প্রাপ্ত শিল্পী ঋতুরূপা তালুকদারের এ প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছিল শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের পারিবারিক উদ্যোগে।
মন্তব্য করুন